রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নতুন ভর্তি হওয়া নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসে প্রথমবারের মতো পদার্পণ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তাদের কল্পনায় ক্যাম্পাস জীবন যেন স্বাধীনতা ও রঙিন স্বপ্নের ভুবন। তবে এই ভুবনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নবীন শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
আবাসন সংকট: মেয়েদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী হোমায়রা আক্তার (হীরা) বলছেন, “রাবির ৭৫৩ একরের এই বিশাল ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধার অভাব মেয়েদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।” প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রাবিতে ভর্তি হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস সংলগ্ন মেসে বা বাসায় উচ্চমূল্যে থাকতে হয়। ফলে তাদের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় এবং মেস মালিকদের কঠোর আচরণ সহ্য করতে হয়, যা শিক্ষাজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। হোমায়রা আক্তার আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হলো মেয়েদের জন্য শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা, যাতে তারা মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করতে পারে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত খালি জায়গা থাকায় এই সংকট দূর করতে নতুন হল নির্মাণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ক্যাম্পাসে আত্মনির্ভরশীলতার সুযোগ
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সোনালী ক্যাম্পাসে নারীদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগগুলো নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন। তার মতে, “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের জন্য আত্মনির্ভরশীলতার এক উজ্জ্বল ঠিকানা। এখানে আমরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং একাডেমিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হতে পারি, যা আমাদের দক্ষতা বাড়াতে এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়তে সহায়ক।” সোনালী আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫টি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ডিবেটিং ফোরামসহ বিভিন্ন ক্লাব রয়েছে, যেখানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেয়েরা তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। ক্যাম্পাসে পার্ট-টাইম চাকরি, অনলাইন ব্যবসা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে মেয়েরা নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক।
নিরাপত্তার চাদরে ক্যাম্পাস
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক নবীন শিক্ষার্থী আনিশা জানিয়েছেন, রাবি ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ নীতিমালা, ২০১০ কার্যকর রয়েছে, যা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক। রাতে মেয়েরা ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে।” আনিশা আরও জানান, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সহায়তাসহ প্রক্টরিয়াল টিম এবং বিশেষ সেল আছে, যা নারীদের সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধানে কাজ করে। এছাড়া প্রবীণ সহপাঠীদের দায়িত্বশীলতা এবং মেয়েদের হলগুলোর নিয়মিত নজরদারি এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো সুরক্ষিত করেছে।
ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ক্যারিয়ার এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুরাইয়ার ভাবনা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্বাধীনতার পাশাপাশি দায়িত্ব এবং নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলেন, “একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন এবং ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার সেন্টার থেকে পরামর্শ নিতে পারলে আমাদের জন্য এটি খুব উপকারী হবে।” তিনি আরও জানান, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সেমিনার, ক্লাব, এবং ইভেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং নিজ নিজ লক্ষ্য অর্জনের দিকে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারে। নেটওয়ার্কিং বা যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন অ্যালামনাই, সিনিয়র এবং প্রফেসরদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
হলে খাবারের মান নিয়ে সমস্যা
হলগুলোর খাবারের মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মৌমিতা বলছেন, “হলের খাবারের মান উন্নত হওয়া উচিত। আমরা কম দামে খাবার পাওয়ার আশা করলেও অনেক সময় এর মান নিম্নমানের হয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।” মৌমিতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হলে খাবারের মান নিয়মিত মনিটরিং করার অনুরোধ জানান এবং খাবারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেন। প্রয়োজনীয় নজরদারির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
নতুন ভর্তি হওয়া নারী শিক্ষার্থীদের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেমন স্বপ্ন পূরণের এক আদর্শ ঠিকানা, তেমনি তাদের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার কেন্দ্র। আবাসন সংকট, নিরাপত্তা, ক্যারিয়ার গঠন এবং খাবারের মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা ভাবনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের এই প্রত্যাশাগুলো পূরণে আন্তরিক হলে, নারীদের জন্য ক্যাম্পাস জীবন আরও আনন্দদায়ক ও সুশৃঙ্খল হবে বলে প্রত্যাশা।