– শামসুল হুদা, ভাষা সৈনিক
মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমন তথা কোভিড-১৯ ব্যাধি সমগ্র পৃথিবীকে তছনছ করে দিয়েছে। দুনিয়াজুড়ে প্রাণ সংহারী করোনার অশুভ ছোঁয়ায় কোটি কোটি মানুষ সংক্রামিত হচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। সারা বিশ্বেই চলছে করোনার প্রাণঘাতী তান্ডব। করোনার এই তান্ডবে সবকিছু লন্ডভন্ড। মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন বিপর্যস্ত। বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি এবং কর্মহীনতা ও মহা মন্দার প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের জীবন নিয়েই করোনা শান্ত হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিকে স্থবির করে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে রাজনীতি, সমাজনীতি ও সংস্কৃতি সবকিছুকেই পঙ্গু করে দিয়েছে। জীবন ও জীবিকার দন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। জীবন আগে না জীবিকা আগে- প্রবল ভাবে এই প্রশ্ন উঠেছে। জীবন না থাকলে কোন কিছুই আর জীবনের প্রয়োজনে লাগেনা। কিন্তু জীবন থাকলে জীবিকা ছাড়া চলেনা। জীবনের জন্যই মানুষের সকল কর্মযজ্ঞ। তাই জীবনের চেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে জীবিকা। ক্ষুদ্র অদৃশ্য এই ভাইরাস সবকিছু পাল্টে দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, করোনার মতো মহামারী পৃথিবীতে নতুন নয়। যুগে যুগে পৃথিবীতে এ ধরনের মহামারী দেখা গেছে এবং অসংখ্য মানুষের সংক্রামন ও প্রাণহানি ঘটেছে প্লেগ, সার্স, মার্স, স্প্যানিশ ফ্লু, গুটিবসন্ত বা স্মল পক্স, কলেরা মহামারী, জিকা ভাইরাস, ইবোলা ইত্যাদি মরণব্যাধিতে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে প্রস্তর যুগে খ্রিস্টপূর্ব ৮৭০০ থেকে ২০০০ সময়কালে, ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে, ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে, ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে এরপর প্রতি ১০০ বছর অন্তর ১৪২০, ১৫২০, ১৬২০, ১৭২০, ১৮২০, ১৯১৮-২০ খৃষ্টাব্দে বিভিন্ন নামের মহামারী সংক্রামিত হয়ে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আবার ১০০ বছর পর এবার ২০২০ সালে আবির্ভাব হয় করোনা ভাইরাসের যা কোভিড-১৯ নামে পরিচিত।
মহামারী পৃথিবীতে জান-মালের ধ্বংসযজ্ঞ জীবন-জীবিকার অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ইত্যাদির সাথে কিছু কল্যাণ-ও সাধন করছে। মহামারীর কারণে সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জীবন-যাপন এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উদ্ভাবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। ধ্বংসযজ্ঞের সাথে পৃথিবীতে মহামারীর কারণে কি কি কল্যাণ হয়েছে তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হচ্ছে-
গরীবের অবস্থার অবনতির সাথে এক ধরনের উন্নতি-ও:
১৪ শতকের ব্ল্যাক ডেথ মহামারীতে পুরো ইউরোপ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। তখন গরীব মানুষের বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। এই মহামারিতে অগণিত মানুষের মৃত্যুর ফলে কর্মক্ষম শ্রমিকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। যোগান কমলে চাহিদা বাড়ে। তাই ওই সময় শ্রমিকের চাহিদা তুঙ্গে উঠেছিল। ইউরোপের গ্রাম অঞ্চলের কৃষি কর্মীরা কাজের শর্তাবলী নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে পেরেছিল এবং বেতন-ভাতাও বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। সুযোগ বুঝে শ্রমিকেরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল- এতে করে ভূমি দাস ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাও ক্ষয়ে যায়।
উন্নতি আসে রোগীর সেবায়:
১৯১৮-১৯২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীতে বিশ্বজুড়ে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ওই মহামারীর কারনে রোগীদের সেবা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। আগে রোগীর যেসব ছোট ছোট স্বাস্থ্য জটিলতা এড়িয়ে যাওয়া হতো সেসব পর্যালোচনার মাধ্যমে দূরীভূত হয়ে যায়। ঐ সময় রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সূচনা হয় এবং নিয়োগকর্তার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বীমা ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এমন অসংখ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর কারণেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারেনি। ওই সময়ে মহামারীতে সব পক্ষেই অনেক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটেছিল। এ কারণে কোনো পক্ষই আর সংঘাতের পক্ষে থাকতে চায়নি।
বাসস্থান ও সুরক্ষা সামগ্রীর উন্নয়ন:
১৯১৮ সালের মহামারীর পর থেকে বাড়ির নকশাতে পরিবর্তন এসেছিল। শহর অঞ্চলে পাশাপাশি বাড়ির মাঝে ফাঁকা স্থান চালুর নিয়ম প্রবর্তন করা হয়, যাতে সংক্রামক রোগ বেশী ছড়াতে না পারে। মহামারীর কারণেই মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী উন্নতমানের করা হয়। যেমন- মাস্ক। আগের মাস্ক ছিল পাখির চঞ্চুর মত। সময়ের সঙ্গে এটি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপে এসেছে। ১৯৬৫ সালে মারাত্মক বিউবেনিক প্লেগ মহামারী আকারে লন্ডনে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই সময় আইসোলেশন, কোয়ারেনটাইন প্রভৃতিতে অভ্যস্থতা তৈরি হয়। ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে লকডাউন ধারণার প্রবর্তন হয় এবং ধীরে ধীরে আসে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার ভাবনাও।
শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নতুন ঢেউ:
মহামারীর রূঢ় বাস্তবতা সবসময়ই বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির নতুন নতুন সৃষ্টিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। ১৩৪৮ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে ছড়িয়ে পড়েছিল প্লেগ। তখন কবি ও লেখক জিওভারি বোকাচ্চ লিখেছিলেন কয়েকটি নভেলের একটি সংকলন। তাতে ফুটে উঠেছিল মহামারী সময়কার বাস্তবতা। যুগ-বিখ্যাত বৃটিশ কবি, নাট্যকার ও অভিনেতা ইউলিয়াম শেক্সপিয়ার একাধিক মহামারীর কবলে পড়েছিলেন। ১৫৯২-৯৩ সালের মহামারীর সময় বেশ কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন তিনি। ১৬০৩-০৪ সালের মহামারীতে তিনি লিখেছিলেন মেজার ফর মেজার। ১৬০৬ সালে যখন আবার বিউবেনিক প্লেগ মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, তখন বাড়ি বসে কাটানোর সময়টায় শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন কিং লেয়ার। কাজ করেছিলেন ম্যাকবেথ ও এন্টনিও অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা নিয়েও। নরওয়ের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অ্যাডভার্ড মুংখা ১৯১৯ সালের শুরুর দিকে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একটু সেরে উঠে তিনি আঁকতে বসে যান এবং নিজের প্রতিকৃতি আঁকায় মনোযোগ দেন ও অন্য অনেক চিত্রকর্ম সম্পাদন করেন। এই স্প্যানিশ ফ্লুর সময়টাতেই টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন ওয়েস্ট ল্যান্ড। এই মহামারিতে ভার্জিনিয়া উলক লিখেছিলেন মিসেস ডলোওয়ে।
২০২০ সালের শুরুতে আবির্ভূত মহামারী করোনার-ও হালকাভাবে কিছু সুফল উল্লেখ করা যায়। যেসব নারী হিজাব পরতে অভ্যস্ত ছিলেন না করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে তারা এখন মাস্ক ব্যবহার করে মুখ ঢাকে, যা হিজাব-এর একটা অংশ বলা যায়। মহামারী করোনার ভয়াবহতার আগে যারা বিভিন্ন অজুহাতে নামাজকে অবহেলা করেছে তারা এখন নিয়মিত নামাজ আদায় করছে। মরণব্যাধি করোনা মহামারী পরিবারের সকলকে একত্রে সময় কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এখন কোমলমতি শিশুদের কর্মজীবী মায়েদের জন্য অপেক্ষা করেও অস্থির থাকতে হয়না। অসুস্থ বাবা-মা সহজে সন্তানের সান্নিধ্য পায়। করোনাকালের অবসরে কবি, লেখক, প্রবন্ধকার, গ্রন্থকার তাদের লেখা চর্চায় নিবিঘ্ন সুযোগ পায়। লুঙ্গী একটা ঐতিহ্যবাহী পোশাক। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা (মিয়ানমার), সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে লুঙ্গীর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। করোনা মহামারী সময়ে লকডাউন ও আইসোলেশনে বাড়ি-ঘরে থাকার কারণে অধিক সময় মনের আনন্দে ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি পরিধানের বেশ সুযোগ হয়েছে। তবে মহামারির কারণে অগণিত প্রাণহানি, মানব-জীবনে সর্বশেষ ধ্বংসযজ্ঞ ও বিপর্যয়ের তুলনায় উল্লেখিত কল্যাণ নগণ্য বিবেচিত।
পরিশেষে পৃথিবীর স্থায়িত্বের উল্লেখে শিরোনাম বিষয়ের ইতি টানছি। অনেকের ধারণা সময় সময় পৃথিবীতে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রতি ১০০ বছরের ব্যবধানে আসমানী গজব হিসাবে মহামারির আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃতির এই বৈরিতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য লড়াকু মানুষ বিভিন্ন আবিষ্কার করে চলেছে। তম্মধ্যে উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে এই উদ্ভাবনী শক্তি বলে মানুষ নীল নদ এবং হোয়াংহাই নদীর ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত উভয় নদ-নদীকে যথাক্রমে মিশর ও চীনের জন্য অভিশাপ এর স্থলে আশীর্বাদের উৎসে পরিণত করেছে। তবে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা যতই আবিষ্কার চালাতে থাকুক কোটি কোটি বছর পূর্বে একটি মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে সেকেন্ডে যে বিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীর ক্রমাগত নিষ্ঠুরতায় সেই একই ধরনের বিস্ফোরণেই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের মতে এই ধ্বংসের পর-ও আরেকটি নতুন বিশ্ব গড়ে উঠবে। মানব সভ্যতা নতুন চেহারায় জেগে উঠবে। বিজ্ঞানের বিজ্ঞান মহাবিজ্ঞান পবিত্র কুরআনের বর্ণনা সূত্রে মহান ইসলাম ধর্ম কেয়ামত, হাশর ও পুনরুত্থান উল্লেখে মানবসভ্যতার নতুন রূপের অনুরূপ আভাস দিয়েছে বহু পূর্ব থেকেই।
শামসুল হুদা, ভাষা সৈনিক
ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক
একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রাপ্ত
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিষ্ট