কাজী হারুন
বাফেলো, নিউইয়র্ক
আসসালামু আলাইকুম।
এই মহাবিশ্বের তারকারাজির ব্যস্ততার মতো আমরাও প্রতিনিয়ত ব্যস্ত আমাদের নিয়ে। স্ত্রী সন্তান বাবা মা ভাই বোন নিয়ে আমাদের যেমন আছে ছোট্ট একটা জগৎ আছে, তেমনি আছে সেই জগতের রুট বা উৎসও। সেই উৎস বা রুট কি, কেন এবং কিভাবে তা আমাদেরকে একটা সরল রেখায় আবর্তিত করছে, সেই রেখা থেকে বিচ্ছুত হলে কি হবে বা হতে পারে সেটাই আমাদের আজকের আলোচ্চ বিষয়। আশা এবং বিনীত অনুরোধ শেষ পর্যন্ত পড়তে চেষ্টা করবেন। “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা সবাই জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। একজন দায়িত্বশীল ইমাম তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের সেও জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের (তার সম্পদ ও সন্তানের), সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্য বা চাকর একজন দায়িত্বশীল, সেও জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এককথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে।’ [সহীহ বুখারী : ৭১৩৮; তিরমিযী : ১৭০৫] আচ্ছা এভাবে যদি একবার চিন্তা করি, ধরুন একটা শিশু এইমাত্র জন্মগ্রহণ করলো। যার কথা বলার, খাওয়ার, কাজ করার, উঠে বসার, এমন কি কাউকে ডাক দেওয়ার ক্ষমতাও নেই! অথচ এই শিশুটিই আগামী বিশ হতে পঁচিশ বছর পরেই এমনি আরেকটি ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু আজই যদি এই শিশুটি মৃত্যুবরণ করে? হ্যা আজই যদি সে মৃত্যুবরণ করে তবে তার আগামী বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। ঠিক তেমনি আমি বা আপনি যদি আজ এই পৃথিবীতে না থাকি তাহলে কি আমার বলে কিছু থাকবে? অবশ্যই না! যেহেতু উত্তর না, সেহেতু আমার বা আমাদের আমিত্ব নিয়ে সকাল সন্ধ্যা চিৎকার চেঁচামেচিরও কোন দাম থাকবেনা। সুতরাং আসুননা আমিত্ব নিয়ে আমাদের দুনিয়াবী যে দৌড়ঝাঁপ তা নিয়ে একটু হলেও চিন্তা করা শুরু করি। আমরা যাঁরা আজকে পর্যন্ত সংসার বা কর্ম করে চলার জন্য হায়াৎ বা জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি তাঁদের প্রত্যেকেরই এই মুহূর্তে কিছু রুট বা শিকড় ভিত্তিক কিছু কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। যেমন ধরুন (১) আমার বা আমাদের সন্তান যেন হয় একজন ভালো মানুষ। (২) আমার বা আমাদের সন্তান যেন হয় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। (৩) আমার বা আমাদের সন্তান বড় হয়ে যেন আমাদের মুখ উজ্জ্বল তথা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রীতিপত্তি অর্জন করতে পারে। (৪) আমার বা আমাদের সন্তান বড় হয়ে যেন বাপ্দা-দার সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পারে। (৫) আমার বা আমাদের সন্তান বড় হয়ে যেন মার্জিত, ভদ্র, নম্র এবং সুনাগরিক হতে পারে। এখন আসুন আমাদের নিজেদের বেলায়! বাস্তব জীবনে আমরা কি উপরোল্লিখিত কর্মপরিকল্পনাগুলোর কোনো সমন্বয় বা প্রয়োগ করেছি? সেই ফুটফুটে ক্ষুদ্র একটা শিশু থেকে বাবা মায়ের অফুরন্ত ভালবাসা আর মমতায় আমি যে আজকের টগবগে একজন মানুষ তার প্রতিদান আমি কতটুকু দিতে পেরেছি অথবা দিচ্ছি? আমি বা আপনি কি আমাদের বাবা মায়ের জন্য আমাকে মানুষ করার পেছনে তাঁদের ত্যাগের কথা স্বরণ করি বা সেই অনুযায়ী চলি? বাবা মা আমাদেরকে মানুষ বানানোর জন্য যেসব চেষ্টা তদবির করেছিলেন সেই অর্থে আমি নিজে কি মানুষ হতে পেরেছি? আমি বা আমরা কি বাবা মায়ের আদেশ উপদেশ অমান্য করে বর্তমানে একজন ঠক, প্রতারক, মিথ্যাবাদী হয়েও নিজেকে “ধোয়া তুলসীপাতা” মনে করি? অথবা নিজে অন্যায় করেও ভাল মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত? আমি বা আপনি কি ঘুষ দুর্নীতির টাকায় সন্তানকে ভাল মানুষ বা সুনাগরিক বানানোর মিথ্যা চেষ্টায় লাফালাফি করছি? আমি কি অন্যের অর্থ বা সম্পদ আত্নস্বাত করেও নিজেকে ন্যায়বান দাবি করি যদিও অন্তর থেকে আমি এসবগুলোর দোষে দুষ্ট! তাহলে মনে রাখতে হবে আমার বা আপনার সন্তান কখনোই ভালমানুষ হবেনা! গ্যারান্টি। আমি বা আপনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাধিন তাধিন করছি আমার সন্তানও তেমনি হবে। আমি বা আপনি আমাদের প্রতিদিনকার কর্মব্যস্ততার জন্য এমন যে, সন্তানের একটু খোঁজখবর ও নিতে ভুলে যাই। ভালোইতো সন্তান প্রতিদিন স্কুলে যায় আসে, বন্ধুবান্দব নিয়ে মজা করে সময় কাটায়, কি সুন্দর গেম খেলে সোনামনি আমার। পড়াশুনাটা ভালোই করছে আমি এতো বেশি খোঁজ খবর করার দরকার কি ইত্যাদি। তাছাড়া আমি বা আমরাও ব্যস্ত! বাসায় এসে নিজেদের মতো একটু সময় কাটাবো নাটক দেখবো পেজ বুকে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিবো অথবা নিজেরাই সময় পেলে গেম খেলা শুরু করবো। সন্তান ব্যস্ত গেম নিয়ে নিজেরা ব্যস্ত ইন্ডিয়ান সিরিয়াল নিয়ে! এর মধ্যেই সন্তান ঘুমিয়ে পড়লো সকালে স্কুলে যাবে। সারাদিন শেষ সন্তানের সাথে একটু খেলাধুলা করার বা সময় কাটানোর কোন সময়ই আমার আপনার নেই! সেই সন্তানের নিকট কি আমরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আবদার করতে পারি? সন্তান বড় হয়ে আমার আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে কিনা অথবা নিজের মুখই সে উজ্জ্বল করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে সম্পূর্ণভাবে আমার আপনার সততা নিষ্ঠা এবং একনিষ্ঠতার উপর আর এটাই হলো রুট। মনে রাখতে হবে আমার আপনার কর্মই আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ। আমাদের কর্ম যদি ভাল না হয় সন্তানের ভাল কর্ম আশা করা আর নিজের সাথে নিজেই প্রতারণা করা সমান কথা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “প্রতিটি নবজাতক তার স্বভাবজাত দ্বীন ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক হিসেবে গড়ে তোলে।” [সহীহ বুখারী: ১৩৫৮] সুতরাং আমি আপনি যা করবো আমাদের সন্তানেরা সেটাই নিজেদের কর্মের মাধ্যমে গ্রহণ করবে। সন্তান বড় হয়ে যেন বাপ্-দাদার সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পারে সেই চিন্তা না করে বরং আমাদের উচিত নিজেরা সৎ ও ন্যায়ের সাথে নিজেদের পরিচালিত করা তাহলে সন্তান আমার আপনার পরিচালিত সরল রেখায় চলবে আর এটা সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিফলন। বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় তথা নৈতিক শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে তাদের সালাতের নির্দেশ দাও, তাদের বয়স দশ বছর হলে এ জন্য তাদের প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরে বিছানা পৃথক করে দাও।” [আবূ দাউদ : ৪৯৫; মুসনাদ আহমদ : ৬৬৮৯] সুতরাং অভিবাবক হিসেবে আমাদের উচিত সন্তানের সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করা, তাঁদের ইচ্ছে অনিচ্ছাকে মুল্যায়ন করে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করা, সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মিশে, কি করে, কি খায়, কি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাঁদের মধ্যে লক্ষণীয় কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে কিনা, কম্পিউটারে সে কি করছে, কি গেম সে খেলছে, কার সাথে সে কথা বলছে, সে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে কিনা এসবই এটি সাবধানে প্রতিনিয়ত খেয়াল করা। নতুবা হঠাৎ একদিন দেখবেন আপনার ছেলে আপনাকে আর সন্মান করছেনা আপনার কথা মেনেও চলছেনা। আপনার মেয়ে হঠাৎ করে আমেরিকান স্টাইলে এটি ক্ষুদ্র জামা কাপড় পরে আপনার সামনে দিয়ে হনহন করে আসা যাওয়া করবে, তখন আপনার আর কিছু করার থাকবেনা। ভাববেননা আপনার সন্তান স্টাইল করছে বস্তুত আপনার সন্তান আপনার রুট বা শিকড়কে অশ্বীকার করছে। আপনি যদি আপনার সন্তানের সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আশা করেন তবে কালবিলম্ব না করে নিজেই আজ থেকে সন্তানের বন্ধু হয়ে যান। আপনার বন্ধুত্ব সন্তানের সকল বন্ধুর চাইতে কাছের হতে হবে যেন সে নিঃসংকোচে সবকিছু আপনাকে বলতে পারে বা আপনার কাছে তার সমস্যা শেয়ার করতে পারে। সত্যটাই তাঁদের বলুন, কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিবেননা কারণ আপনার আমার মিথ্যার আশ্রয় তাঁদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। নিজে সত্য বলুন, সন্তানকে সত্য বলতে শিক্ষা দিন। সন্তানকে সকল প্রকার অনিয়ম হতে রক্ষা করতে হলে, পিতা-মাতা তাদের শিষ্টাচার সম্পন্ন, সভ্য ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে সাহায্য এবং তাকে অসৎ সঙ্গ থেকে বিরত রাখতে নিয়িমিত খেয়াল রাখতে হবে এবং নিজেরাও বিরত থাকতে হবে। পারিবারিক জীবনে সন্তান-সন্ততি কতবড় নিয়ামত তা যাঁর সন্তান হয়নি তিনিই সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করে থাকেন। যাঁদেরকে আল্লাহ রাববুল আলামীন সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্বও অর্পণ করেছেন। পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি আমরা সন্তানকে আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে না তুলতে না পারি।
সবাইকে শুভেচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ, আসসালামু আলাইকুম।