– শামসুল হুদা, ভাষা সৈনিক
আজকাল সারাবিশ্বে নেতা শব্দটি খুবই সহজে ব্যবহার হয়। নেতা কিন্তু কোন একটি বিশেষ মানুষ নয়। নেতা হচ্ছে অনেকগুলো মানুষের সমষ্টি। যে মানুষের মধ্যে অনেক মানুষ, থাকে তিনি হচ্ছেন নেতা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রকারভেদে পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের নেতার কথা জানা যায়- যেমন মনোনীত ও অমনোনীত নেতা, স্বৈরাচারী নেতা, জনহিতৈষী নেতা, গনতান্ত্রিক নেতা ইত্যাদি। প্রকৃত নেতার স্বপ্ন ও কল্পনা শক্তি থাকে। কল্পনা শক্তির প্রয়োজন জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য। আর জ্ঞানবাণই নেতার যোগ্য। সত্যের সাধক ও সততার অধিকারীই নেতার যোগ্য। প্রকৃত নেতার ধমনীতে স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের গুণাবলী প্রবাহিত। কল্পনাশক্তি হচ্ছে এমন কিছু যা একজন নেতাকে নেতৃত্ব দেয়, পথ দেখায়। যখন তিনি তাঁর এই কল্পনাশক্তিকে হারিয়ে ফেলেন এবং অন্য কোন ঘটনা দ্বারা পরিচালিত হতে বাধ্য হন, তখন তিনি নেতার অযোগ্য, কেবল নামমাত্র নেতা। এই কল্পনা শক্তি বা ভবিষ্যৎ জানতে পারার জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করতে না পারার ব্যর্থতা তাকে নেতৃত্তের পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। পৃথিবীতে সকল নেতার-ই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল যা তারা সম্পন্ন করেছেন। সেই স্বপ্নই তাদের প্রতিটি চেষ্টার পেছনে শক্তি যুগিয়েছে। প্রকৃত নেতার একটি সমাজ পরিবর্তনের কল্পনাশক্তি থাকে। একবার হেলেন কেলারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “অন্ধ হয়ে জন্ম নেওয়ার চেয়ে খারাপ কি হতে পারে।” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “দৃষ্টি আছে কিন্তু স্বপ্ন নেই, এর কি ফায়দা?” দুঃখের বিষয় হচ্ছে অনেক লোকেরই একটি পরিকল্পিত স্বপ্ন ব্যতিত সংগঠনের নেতৃত্ব দান পদে বসানো হয় এবং তাদের থেকে নেতৃত্ব আশা করা হয়। সহজ কথায় নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হয় না, ওপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় বা নেতা বানানো হয়। আর তারাই সমাজের সব অপকর্ম করে বেড়ায়। সকলের অধিকার কেড়ে নিয়ে নিজে অধিকার চর্চা করে। নিজের ভোগবিলাসের জন্য গড়ে তোলে সম্পদ ও সাম্রাজ্য। বিশ্বের সকল মহান নেতাই দুই জিনিসের অধিকারী ছিলেন। তারা জানতেন তারা কোথায় যাচ্ছেন, উদ্দেশ্য কি, এবং তারাই অন্যদেরকে নিজের অনুসারী হতে সক্ষম হয়েছিলেন। থিওজের হেসবুর্গ বলেছেন, “নেতৃত্বের জন্য একটি ভিশন থাকা অত্যাবশ্যক। যার ভিশনের অভাব রয়েছে কিংবা যে অন্য কারো স্বপ্নের নেতৃত্ব দিতে চায়, সে নিষ্ফল। যে তার নিজের ভিশনের নিশ্চিত কারনে সফল, সেই প্রকৃত নেতা এবং অনুসারীরা তাকে মনেপ্রাণে ভালবাসবে।”
বিশ্বের বহু মহান ব্যক্তি তাদের জীবন দারিদ্র্য থেকে আরম্ভ করেছেন। তাদের জন্ম হয়েছিল কুঁড়েঘরে। তাদের ছিল অল্প শিক্ষা এবং বিশেষ কোনো সুবিধা ছিল না। থমাস আ. এডিসন ট্রেনে সংবাদপত্র বিক্রি করতেন। এন্ড্রু কার্নেগী মাসে ৪০০ ডলার বেতনের চাকরি শুরু করেন। জন ডি. রকফেলার মাসে ৬০০ ডলার বেতনের কাজ আরম্ভ করেন। আব্রাহাম লিংকন একটি জীর্ণশীর্ণ এককক্ষের বাসায় জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু অবিস্মরনীয় ব্যাপারটি হচ্ছে তিনি উত্তরকালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ডিমসডেনেস প্রাচীন পৃথিবীর একজন মহান বক্তা ছিলেন, অথচ তার তোতলানোর সমস্যা ছিল। জুলিয়াস সিজার ছিলেন একজন মৃগীরোগী। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নকে অনেকেই ভাগ্যবান ও প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আসলে তিনি তা ছিলেন না। চার্লস ডিকেন্স এবং হেনডেল ছিলেন পঙ্গু। হোমার ছিলেন অন্ধ, প্লেটো ছিলেন কুঁজো, স্যার ওয়ালটার ছিলেন প্যারালাইজড।
এই মহান ব্যক্তিদের ভেতরে কি ছিল যা তাদেরকে এমন কঠিন সব বাধা অতিক্রম করে সফল করেছে? এই ব্যক্তিদের প্রত্যেকেরই মনের ভেতর একটা স্বপ্ন ছিল, ভিশন ছিল, যে স্বপ্ন তাদেরকে বাধার সামনে হার মানতে দেয়নি। মহান কল্পনাশক্তির আরম্ভই হয় একজন ব্যক্তির ভেতর থেকে এবং নেতার সার্থকতা আসে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে। কল্পনাশক্তির একটা সমর্থন বা আশ্রয় লাগে। সেই সমর্থন বা আশ্রয় হচ্ছে নেতা স্বয়ং। কল্পনা, সপ্ন, ভিশন নেতাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার মানচিত্র। নেতা সঠিক ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও নানা প্রক্রিয়ায় তা বাস্তবায়ন করবেন। নেতার দৃঢ় সংকল্প ও কর্মপন্থায় আকৃষ্ট হয়ে লোকজন নেতাকে-ও তার ভিশনকে বিশ্বাস করবে ও নেতাকে তার কাজগুলো করতে সমর্থন দেবে। নেতা হতে হলে তাকে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। নেতাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্তে সুফল, আর ভুল সিদ্ধান্তে কুফল। বিশ্ব নেতাদের জীবনী ও কার্যক্রম আলোচনা করলে এর সত্যতা মেলে।
একটি উদ্দেশ্যকে অনুধাবন করতে একতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত নেতা হতে হলে ব্যক্তিগত চাহিদা উপেক্ষা করে ঐক্যবদ্ধ দলের গুরুত্ব বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে হয়। তখন সকলের চাওয়া-পাওয়া নিজের চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে চলে আসে এবং সেটাকে বাস্তবায়ন তার একমাত্র ব্রত হয়ে ওঠে। সমস্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সত্যপথ ধরে চলার আদর্শ জেগে ওঠে নেতার মনে। প্রকৃত নেতা সঠিকভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের নানা প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবেন। ইনিই প্রকৃত নেতা, যিনি যেটা অযৌক্তিক, যেটা অগ্রহণযোগ্য, যেটা অসন্তোষজনক, যেটা ভুল, যেটা মিথ্যা- সেটার প্রতিবাদ করতে পারেন। সেই মানুষই নেতৃত্ব দিতে পারে যে এই সবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) এর আবির্ভাব কালে আরবে অনেক ঈশ্বর ও মূর্তিপূজা প্রচলিত ছিল। কঠিন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি কি এসব কুকর্ম মেনে নিয়েছিলেন? গৌতম বুদ্ধ যখন আসেন, তখন হিন্দুদের মধ্যে প্রকট জাতিভেদ প্রথা ছিল। তিনি এই জাতিভেদ এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোপারনিকাস কারো কথামতো সে যুগের ক্রিস্টিয়ান চার্চকে মেনে নেননি। যিনি যত বড় নেতা হবেন, তিনি তত বেশি বিনয়ী হবেন। বিনয়ী না-হলে প্রকৃত নেতা হওয়া যায় না। নেতা বিনয়ী না হয়ে দাম্ভিক ও স্বার্থপর হলে তার সমস্ত অর্জন ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আদর্শ নেতার এই গুণটি থাকা একান্ত আবশ্যক। একজন আদর্শ নেতাই পারেন সামাজিক পরিবর্তন এনে সমৃদ্ধ দেশ গঠন করতে। নেতাকে অবশ্যই ইতিবাচক হতে হবে। নেতা যদি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করেন, তাহলে সমাজ পরিবর্তন ও মানুষের জীবন যাত্রার মান বদলে দিতে পারেন। ইতিবাচক মনোভাব সফলতা অর্জনের প্রথম সোপান। একজন নেতাকে অবশ্যই জ্ঞানী হতে হবে। ‘জ্ঞানই শক্তি’ কথাটি তাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। নেতাকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। একজন সফল ও আদর্শ নেতার সবচেয়ে বড় গুণ তার ন্যায়নীতি, সততা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নেতা হতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসিক বিকাশ। যাকে আমরা বলতে পারি ‘আত্মশুদ্ধি’ বা মূল্যবোধ। আর এই নীতি, নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এসবকিছুই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত নেতা ভারতের মহাত্মা গান্ধী, চীনের মাও সেতুং, আফ্রিকার নেলসন মেনডেলা, আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য কতিপয় নেতার উদাহরণ টানা যায়।
পরিশেষে প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের পেক্ষাপটে নেতৃত্ব নিয়ে একটা রেখাচিত্র। ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক থেকে সারা বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে রয়েছে মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বৎসর ও মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর-ও বাংলাদেশ প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর কাংখিত সোনার বাংলার আশানুরূপ রূপদান করতে পারেনি।
সম্পদ, ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হওয়া সত্বেও উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পারছে না। এর মূল কারণ দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, রাজনৈতিক সহিংসতা, রাজনৈতিক মিথ্যাচার ইত্যাদি অনিয়ম, অঘটন এবং এই সব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণের ও দূরীকরণের ব্যর্থতা, এ যাবতের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের। ব্যর্থতার কারণ নিঃস্বার্থ নেতৃত্বের অভাব এবং সরিষার ভেতর ভুতের অবস্থিতি বলে অনেকে মনে করে। বর্তমানে যদিও দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও অগ্রগতি হচ্ছে সমান্তরালভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম সমভাবে চলছে এবং প্রভাবশালীরা সব উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। অপরদিকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলে উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য স্বজনপ্রীতির উর্দ্ধে ন্যায়-নিষ্ঠা, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমী নেতৃত্তের প্রয়োজন, যে নেতৃত্ব উল্লেখিত অনিয়ম ও অপকর্ম থেকে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হতে পারে।
লেখক: ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক
একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট