Thursday, November 7, 2024
Homeখোলামতআমেরিকার নির্বাচন নীতি প্রসঙ্গঃ বাফেলোর সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচন

আমেরিকার নির্বাচন নীতি প্রসঙ্গঃ বাফেলোর সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচন

– মো: হাফিজউদ্দিন আজমল

পৃথিবীর নানান দেশের, নানান জাতির, নানান বর্ণের, লোকদের অভিবাসী হিসেবে নাগরিকত্ব লাভ করে বাসিন্দা হয়ে মূল অধিবাসীদের সাথে একাকার হয়ে সৃষ্ট আজকের এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমুন্নত গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অন্যসব জাতিকে শিখিয়ে দেয় জাতি গঠনের মূল মন্ত্র, শিখিয়ে দেয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের তীর্থস্থান। এদেশের প্রতিটি মানুষই গণতান্ত্রিক ও গণতন্ত্রপ্রেমী।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকায়-ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের পক্ষ-বিপক্ষ থাকেই এবং জয় লাভের জন্য দেশে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যেমন সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় তৎপর থাকে, তেমনি তাদের সমর্থকরা-ও প্রচারণায় এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে উন্মুক্ত বিতর্কে লিপ্ত হয় পরস্পরের প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য। নির্বাচন শেষে বিজয়ী প্রার্থী এবং বিজিত প্রার্থী নির্বাচনকালীন সব দ্বন্দ্ব, বিভেদ ভুলে গিয়ে মধুর সম্পর্ক স্থাপন করে এবং পরাজিত প্রার্থী বৃহত্তর স্বার্থে একযোগে কাজ করে বিজয়ীকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। দুই পক্ষের সমর্থকরা-ও নির্বাচনকালীন সব বিভেদ ভুলে গিয়ে মিলেমিশে পূর্ববৎ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত প্রথা ও নীতি।

কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন দ্বন্দ্ব-বিভেদ নির্বাচন শেষে আর-ও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। নির্বাচন শেষে-ও বিজয়ী-বিজিত এক পক্ষ অপর পক্ষকে বিষোদগার ও ঘায়েল করতে সচেষ্ট থাকে। দেশে অরাজকতা সৃষ্টিতে তৎপর থাকে। নীতিহীন রাজনীতি এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি হলো বাংলাদেশের প্রচলিত রীতি।

বাফেলোর সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচনের ব্যাপারে একটু আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। উল্লেখ্য, রাজনৈতিকভাবে নিউইয়র্ক রাজ্যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাধান্য। এখানে রিপাবলিকান পার্টি কোণঠাসা। বাফেলোর মেয়র নির্বাচনে বায়রন ব্রাউন এবং ইন্ডিয়া ওয়ালটন দুজনেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। ব্রাউন যদিও চার বারের মত একটানা ১৬ বছর বাফেলো’র মেয়র পদে অধিষ্ঠিত, কিন্তু জুন প্রাইমারিতে ওয়ালটন জয়ী হয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অফিশিয়াল প্রার্থী হন। কিন্তু ব্রাউন পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অফিশিয়াল প্রার্থী না হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাইট-ইন-ক্যান্ডিডেট হিসাবে নভেম্বর ফাইনালে প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মেয়র নির্বাচনে বাংলাদেশী কমিউনিটির ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে কমিউনিটিতে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয় এবং দেশবাণী পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামেও এই নির্বাচনে বাংলাদেশীদের ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়। মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই প্রার্থীর শিবির থেকেই বাংলাদেশিদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তাদের সাথে সভা-বৈঠক করা হয়। বাংলাদেশিরাও সক্রিয় থেকে দুই পক্ষের প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। নতুন কমিউনিটি হিসাবে বাংলাদেশিরা মেয়র নির্বাচনে একতাবদ্ধ থাকার মধ্যেও কারো কারো হয়তো ব্যক্তিগত পছন্দের সিদ্ধান্ত-ও থাকতে পারে। এটা গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে স্বাভাবিক। তবে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাংলাদেশীদের অধিকাংশ ভোটই বায়রন ব্রাউনের পক্ষে প্রদত্ত হয়েছে।

উল্লেখ্য, কিছুসংখ্যক বাংলাদেশী নির্বাচনকালীন ভিন্নমত না ভুলে নির্বাচন শেষে কিছু লোকদের কাল্পনিকভাবে বিরুদ্ধপক্ষ ভেবে তাদের ওপর অশোভনীয় মনোভাব পোষণ করতঃ কটাক্ষ করে চলেছেন, যা গণতান্ত্রিক আচার ও আমেরিকার নীতিবহির্ভূত। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের চলমান প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক আচরণ অনুসরণ। এ ধরনের আচরণ বাংলাদেশী আমেরিকান তথা আমেরিকান নাগরিক হিসাবে অনভিপ্রেত এহেন অপরাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং বাংলাদেশী কমিউনিটির সকলের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার পরিবেশ বজায় রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, প্রমাণ করতে হবে আমরা বাংলাদেশিরা আদর্শবান ও প্রশস্ত মনমানসিকতার অধিকারী একটা সুশৃংখল সম্প্রদায় আমেরিকার বাসিন্দা ও নাগরিক হিসেবে। বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, এমনকি ঘরোয়াভাবেও উল্লেখিত বিষয়ের গুরুত্ব আলোচনায় আনতে হবে, যাতে বাংলাদেশি কমিউনিটির সকলে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে পেশাদারিত্ব নিয়ে একটু আলোচনায় আসি। একটা সমাজে যেমন নানা শ্রেণির পেশা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আলাদা আলাদা কাজ। এক পেশার মানুষ অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করতে গেলে বিপত্তির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সকল পেশার মধ্যে একমাত্র সাংবাদিকতাই হলো ব্যতিক্রম। সাংবাদিকতা একটা সম্মানজনক পেশা, আর সংবাদপত্র হল সমাজের দর্পণ। সমাজের প্রতিটা পেশার, প্রতিটা পর্যায়ের ভুলত্রুটি এবং অর্জনকে মিডিয়ার মাধ্যমেই দেখা যায়, জানা যায়। সব পেশার ভিন্ন ভিন্ন দর্শণ, আলাদা রাজনৈতিক মতবাদ থাকতে পারে, যা প্রকাশ পাবে মিডিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু একজন মিডিয়া ব্যাক্তিত্বের রাজনৈতিক মতবাদ হবে তার একান্ত ব্যক্তিগত। সংবাদ প্রকাশে বা কোন কভারেজে কোনোভাবেই তা’ প্রতিফলিত হবে না। কারণ এটা সংবাদপত্রের এথিক্স বা নৈতিকতা ও নীতি। নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশই হলো সংবাদপত্রের নীতি।

বাফেলোতে বছরখানেক হলো ‘দেশবাণী’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা যাত্রা শুরু করে। দেশবাণী পত্রিকা নৈতিকতা বজায় রেখে বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক, সময়সাময়িক ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক তথ্য-সমৃদ্ধ ঘটনা প্রকাশ সর্বোপরি কেবল বাণিজ্যিক দিকে নজর না দিয়ে সৎ সাংবাদিকতাকে পেশাদারী দায়িত্ব মনে করে পথ চলা শুরু করে এবং একই সাথে বাংলাদেশী কমিউনিটির কল্যাণে কাজ করতে সচেষ্ট থাকে। ফলে দিন দিন দেশবাণী পত্রিকার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পত্রিকাটি বিশেষভাবে পাঠক সমাদৃত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সকলের প্রত্যাশা দেশবাণী এই প্রচেষ্টা ও কর্ম তৎপরতা অব্যাহত গতিতে চালিয়ে এগিয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচনের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও নৈতিক মনোবৃত্তির পত্রিকা ‘দেশবাণী’র ভূমিকা নিয়ে একটি বিবাদ সৃষ্টিকারী মহল কর্তৃক কিছু অনভিপ্রেত ও অযৌক্তিক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। পত্রিকাটির নিরপেক্ষতাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পক্ষপাতিত্ব ভুল আখ্যা দিয়ে নির্বাচনী প্রচার অনুষ্ঠানের আয়োজকদের প্রভাবিত করতঃ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং অনুষ্ঠানের কোনো বক্তব্য বিবৃতি বা সংবাদ পত্রিকাটিতে পাঠানো-ও বন্ধ রাখা হয়। এতদসত্ত্বেও ‘দেশবাণী’ নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বার্থে নিজস্ব প্রচেষ্টায় সব পক্ষের সংবাদ যথাসম্ভব সংগ্রহ করে সমান গুরুত্ব সহকারে পত্রিকায় কভারেজ দিয়ে থাকে।

পরিশেষে বলা প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি- বাফেলোতে বর্তমানে যেভাবে বাংলাদেশি বসতি ও কর্মকান্ড বেড়ে চলেছে, দুটি মাসিক বাংলা পত্রিকা মোটেও বেশি নয়- যেখানে নিউইয়র্ক সিটিতে সাপ্তাহিক হিসাবে ২০টির-ও অধিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত। একটি পত্রিকা অন্য পত্রিকার প্রতিদ্বন্দী বা প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী ভাবা উচিত। সকলকে এই উদার মন-মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে।

আমাদের ছোট কমিউনিটিতে কোন বিভাজন নয়। সকলকে একতাবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘United We Rise, Divided We Fall’. তবে ঐক্য শুধু মুখে নয়, বাস্তবে প্রতিফলিত করতে হবে। ঐক্যই কমিউনিটির মঙ্গল। এদিকে তরুণ প্রজন্ম তথা যুব সমাজকে প্রকৃত শিক্ষায়, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কমিউনিটিতে সত্য, ন্যায়, নৈতিকতা ও ঐক্যের ধারক ও বাহক হতে পারে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments